তারিখ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

স্মৃতি চারণ-প্রিয়মুখ জনমানুষের নেতা সেই নজরুল ইসলাম সরকার

স্মৃতি চারণ-প্রিয়মুখ জনমানুষের নেতা সেই নজরুল ইসলাম সরকার
[ভালুকা ডট কম : ০৭ আগস্ট]
মানুষের উন্নয়নের ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি। একবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসেছিলেন জাতীয় পর্যায়ে। ধাপেধাপে এই উঠে আসা, আজও অনেকের নিকট উদাহরণ! গণমানুষকে গণকন্ঠের হৃদয়ের সাগরে ভিজিয়ে ছিলেন। হৃদয় জয় করে ম্যান্ডেট পেয়েছেন। অর্থ, দাপট, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে হয়নি তাঁর। প্রতিটি মানুষের আপন মানুষে পরিণত হন সেই নজরুল ইসলাম সরকার। যাঁকে এখনো খোঁজেন ফিরেন নজরুল ইসলাম সরকারের প্রিয় ভক্তরা। এই অপেক্ষার ২৪ বছর পরেও নজরুল ভক্তদের মাঝে তাঁর শূন্যতা যেন আজও পূরণ হলো না!

তিনি ১৯৯১সনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদ অধিবেশন শেষে মোটর সাইকেল যোগে গৌরীপুরে আসার পথে ১৯৯২সালের এই দিনে ৮আগস্ট ময়মনসিংহ-ঢাকা সড়কের তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সামনে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সহনাটীতে ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখ। গিধাউষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম ও ঈশ্বরগঞ্জের চরনিখলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। গৌরীপুর মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম সরকার তার শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটান।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পাকিস্তানী শাসনামলের শেষের দিককার প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের থানা কমা-ারের দায়িত্ব পালন করেন। গনমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি নিজ এলাকার খুবই জনপ্রিয়। তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বলতে গেলে দুর্গম পাড়িয়ে আলোর জগতে প্রবেশ করেন এই মানুষটি। তার বাবার নাম আব্দুল করিম সরকার।

১৯৭৮সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী মোছাঃ রওশন আরা। দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যা এবং এক পুত্রের জনক ছিলেন। তিনি উপজেলার সহনাটী ইউনিয়ন পরিষদের তিন তিন বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ছাত্র জীবন শেষে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হন। দলের প্রতিটি কর্মসূচীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯১সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে ময়মনসিংহ-৩ আসনে নির্বাচিত হন। তরুণ রাজনীতিক নজরুল ইসলাম সরকার সামাজিক কর্মকান্ডের অঙ্গনেও বলিষ্ঠ পদচারণা অব্যাহত রাখেন। তিনি পাছার উচ্চ বিদ্যালয়, গিধাউষা হাসন আলী উচ্চ বিদ্যালয়, নিজ ইউনিয়নের দু’টি মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি পা-িত্য থাকতে হবে কি, না? সেটা আমার জানা নেই! তবে নজরুল ইসলাম সরকার শুধু একজন মানুষ তা নয়, আমার দৃষ্টিতে তিনি একজন প-িতও ছিলেন। তা না হলে আজকের দিনের সামাজিক যে অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে তা, তিনি জীবনদশায় তখন কিভাবে বললেন! হয়তো অনুমেয় তবে আজকের প্রেক্ষাপটে বলতে হবে, সত্যিই তিনি প-িত। সেই প্রশ্নোত্তর হলো ঃ ‘আগামী ২০০০ সালের বাংলাদেশের একটি বর্ণনা তুলে ধরার অনুরোধ জানানো হলে, নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও উন্নয়নের গতির মধ্যকার যে পার্থক্য তা যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাহলে আগামী ২০০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ সামাজিক অস্থিরতার ও নৈরাজ্যের দেশে পরিণত হবে।’ এই বক্তব্যটি মনজুর-এ-মাওলা সম্পাদিত একটি রাজনৈতিক দলিল গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদ’৯১ এলবামে’ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত সংসদ এলবাম থেকে নেয়া। যা ছাপা অক্ষরে প্রকাশের সংখ্যা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

আমার বাড়ি পৌর শহরের সতিশা গ্রামে। পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই ছিলো ইটভাটা। যারা মাটি কেটে লোদ (ঘারা) তৈরি করতো ওদের নাম ঘারাওয়ালা। পুরো শরীরে কাঁদা। হাত-পায়ে লোদের প্রলেপ মনুষ্য রূপও বদলে দিয়েছে। অথচ তাদের সাথে কুলাকুলি করে ছিলেন। ঘামে ভেজা ওদের শরীরকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। কাঁদায় মেখে ছিলো হাত, শরীরের জামা। চাষের জমিতে ধানের চারা রোপন চলছে। ক্ষেতের মাঝখানে সেই কৃষকদের সাথে মিশে ছিলেন। যেখানে যখন যা পেয়েছেন, দরিদ্র, গরীব যে ঘরেই মিলেছে খাবার সেখানেই খেয়েছেন। আজকের মতো নেতাকর্মী তখন গ্রামে গ্রামে এতো ছিলো না। আজ নেতা যান, খান কর্মীর বাড়িতে। এই কর্মীদের নিকট জনগণের সেই ভালোবাসা, ভালোলাগা যেন বন্ধকী হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে সেই কর্মী এই নেতার ঘাড়ে বসে মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গেন। এটা সবাই নয়, তবে সিংহভাগতো হবেই। নজরুল ইসলাম সরকার ভালোবাসার বন্ধনে বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণেই নিজ ইউনিয়নকে দলীয় ঘাঁটিতে পূরণ করতে পেরেছিলেন।

আজকে তাঁর সেই জন্মভূমি সহনাটী ইউনিয়নকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অধিকাংশ জনসভায় বলতে শোনা যায়, এটি দ্বিতীয় টঙ্গীপাড়া। ভোটের হিসাবে নজরুল ইসলামের তৈরি মাঠ এখনো সেই অবস্থানে থাকলেও তাঁর স্বপ্নের উন্নয়ন এ ইউনিয়নে আজও হয়নি। তাইতো আজও পথপানে চেয়ে রয় এই বুঝি নজরুল এলো। উদার মনের সেই নজরুলকে খোঁজে ফিরছে সহনাটীবাসী। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদেই আজও সহনাটীতে নজরুল অমর হয়ে রয়েছেন।

তৎকালীন সময়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা ছিলেন। নজরুল ইসলাম সরকার জনমানুষের ভালোবাসা পেলেও হয়তো ভোটের হিসাবে বরাদ্দ পাননি, তাই কাঙ্খিত স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। তিনি চলে যাওয়ার পর উপনির্বাচনে উক্ত আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাঁরই সহধর্মিনী মোছাঃ রওশন আরা নজরুল। যৎসামান্য বরাদ্দ আর আন্দোলনেই কেটে গেছে বাকী সময়টুকু।

তৃণমূল থেকে উঠে এসে, সেই মানুষটি বলেছিলেন, ‘গনতন্ত্রের ব্যপারে এখানে আমরা প্রায় সবাই নবীশ’। তিনি গনতন্ত্র চর্চা, গনমানুষের জন্য কাজ করতে চেয়ে ছিলেন। এ সাক্ষাৎকারে তিনি এতো কিছু বলেছিলেন, যা আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

সেই দিন তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলে ছিলেন,  ‘আমাদের দেশের বাস্তব যে অবস্থা তাতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে হলে সমবায় পদ্ধতির প্রসার ঘটাতে হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে এ শুধু প্রশ্নের উত্তর নয়, পথ চলার দলিল। যা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। গ্রামীণ উন্নয়নের গুরুত্ব না দেয়ার কারণেই শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলো বাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এখনো গ্রামে-গঞ্জে তেমনভাবে গড়ে উঠেনি ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প। সমবায় পদ্ধতির কথা বলা হলেও, এর সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস জন্ম নেয়ার পিছনেও রয়েছে এসব ক্ষেত্রে গাফিলতির যুগের ফল।

তিনি আরও বলে ছিলেন ‘আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধগুলিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন অর্থনৈতিক ক্লিষ্টতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য। কেননা মানুষের প্রয়োজন, কোন আইন মানে না। অভাব তীব্র হলে মূল্যবোধ লালন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো এবং প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষের উপার্জনের রাস্তা খুলে দিতে হবে। সাথে সৎ সংস্কৃতির চর্চা ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং অভিভাবকদের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে পালন করতে হবে আরো সচেতন ভুমিকা। যে সরকারই ক্ষমতায় যান অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানা প্রকল্প গ্রহণ করেন অথচ এক্ষেত্রে প্রতিটি সরকারই বারবার কেন যেন ব্যর্থ হচ্ছে। নজরুল ইসলাম সরকারের এ বক্তব্য আজকের প্রেক্ষাপটে বলতেই হয়, গণকের বর্ণনা। মনে হচ্ছে মূল্যবোধ বিবর্জিত জাতিতে পরিণত হচ্ছি আজ আমরা।

দেশের প্রধান সমস্যা ও সমাধানের পন্থা সম্পর্কের প্রশ্নোত্তরে বলে ছিলেন ‘অনেক সমস্যাার মধ্যে আমার মনে হয় বেকারত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাই আমাদের প্রধান সমস্যা। বেকারত্ব দুর করতে হলে শিল্পায়নের কোন বিকল্প নেই। তবে, শিল্পায়ন উদ্যোগকে দেশীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে পরিকল্পিত পরিবার গড়ার আন্দোললকে সামাজিক আন্দোলনে উন্নিত করতে হবে। বাড়াতে হবে শিক্ষার হার ও জনগনের সচেতনতার মাত্র। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা দুর করতে হলে অনবরত গনতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা করে যেতে হবে।’  

বেকারত্ব, দুর্নীতি ও শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস রোধে জবাবে তিনি বলে ছিলেন ‘শিল্পায়নের মাধ্যমে বেকারত্বের সমাধান করা সম্ভব। দুর্নীতি রোধে সকল স্তরে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা চালু, কঠোর আইনগত পদক্ষেপ ও সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করা সম্ভব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমেই।’ বর্তমানে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটুকু টেকসই এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলে ছিলেন ‘আমাদের দেশ গনতন্ত্র বারবার যাত্রারম্ভেই হোঁচট খেয়েছে। এর কুফল ভোগ করতে হয়েছে রাজনৈতিকদেরকেই সবচাইতে বেশি। ফলে তারা ঠেকে অনেকটা শিখেছেন। তবে, গনতন্ত্রের ব্যাপারে এখন প্রায় সবাই নবীশ। ভুল-ত্রুটি হচ্ছে, হবেও। এর মধ্য দিয়ে গনতন্ত্র টিকে থাকবে বলে আমি আশা করি।’ #




সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

পাঠক মতামত বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই