বিস্তারিত বিষয়
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনা
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনা
[ভালুকা ডট কম : ২২ মার্চ]
স্বাধীনতার ৪৮বছর পেরিয়ে গেলেও নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০বীরাঙ্গনা আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। তারা এখনো অবহেলিত। সরকার ঘোষিত সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ১৯৭১ সালে দেশ-মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে এই সব নারীরা বীরোত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আজ পর্যন্ত রাষ্টীয় সম্মাননা পাননি।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা পাল পাড়া গ্রামে বসবাস করেন রেনু বালা, মায়া সূত্রধর, রাশমুনি সূত্রধর, কালীদাসী পাল, সুষমা পাল, সন্ধ্যা পাল, ক্ষান্ত বালা পালসহ ১০জন বীরাঙ্গনা। এদের মধ্যে বাণী রাণী পাল ও কান্তা রানী পাল মারা গেছেন। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রনা, সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুদর্শার অভাব-অনটন আর অসুস্থ্যতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা প্রতিবছর বীরাঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সেই তালিকায় নওগাঁর রাণীনগরে ১০জন বীরাঙ্গনার নাম তালিকাভূক্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়ায় ঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক হানদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের প্্রত্যক্ষ সহযোগীতায় প্রকাশ্য দিবালোকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায়। এই সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নীসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী, ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেস্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে “জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়” এভাবে পাক সেনারা ব্যাঙ্গাত্তো উক্তি করতে করতে ব্্রাশ ফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারন পালসহ ৫২ জন মুক্তি কামী জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সময় পাক হানদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংস লীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও পাক-জান্তাদের মন গলাতে পারেনি। উল্টো পাক-জান্তারা সুযোগ বুঝে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। ৫২ শহীদের তাজা রক্তে সে দিন নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়ে ভাসিয়ে যায়। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল।
১৯৭১ সালে এই গ্রামে পাক-বাহিনীর নির্যাতনের আলাপকালে কালীদাশি পাল (৭৮) জানান, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবী আসে তখন আমর স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্নগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাদের সহযোগীতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবীরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানান কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিন মজুরের কাজ করে। আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিম্বা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি।
স্বাধীনতার ৪৮বছর পার হলেও আমাদের খোঁজ খবর কেউ নেয়নি। আপনারা (সাংবাদিকরা) আসছেন যদি পেপারে দিয়ে রাষ্ট্রের সু-নজরে আসে জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে আর্থিক কিছু সুবিধা পেলে অভাবের সংসারে কিছুটা কাজে লাগতো।
সুষমা পাল (৬৭২) জানান, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুড় ও অগ্নীসংযোগসহ নানা ধরণের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্র ছেলেকে নিয়ে পার্শ্বের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় নেই। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক-বাহিনীরা মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে।
প্রয়াত বাণী রানী পালের মা ও ছোট ভাই জয়ন্ত পাল জানান, একাত্তরের ঘটনার কথা জানতে চাইলে মাথা নিচুঁ হয়ে যায় তাদের। ক্ষোভে কষ্টে তাদের চেহারা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠে। তার পরও বলেন, একাত্তরের ২৫ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে নদী পার হয়ে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাক বাহিনী আমাদের পাড়ায় ঢুকে লুটপাট, ভাংচুড়, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাণী পালের চোখের সামনে তার বাবা শ্রীমন্ত পালকে ধরে মারপিট শুরু করে। সাথে সাথে বীরের মতো সেই সময়ের কিশোরী বাণী পাল পাঞ্জাবীদের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে পাশের একটি কূপে ফেলে দিয়ে হাতাহাতি শুরু করলে পাক-হায়েনারা তার বাবাকে গুলি চালালে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভাগ্যেক্রমে সে বাঁচলেও বাণী পাল তাদের নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে রেহায় পায়নি। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে জয়ন্ত এক পর্যায় বলেন, লজ্জা ঘৃণায় আমার দিদি বিবাহ না করেই অবশেষে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা করতে না পেরে মারা গেলেন। তবে বীরাঙ্গনার স্বজনরা লজ্জা ঘৃণা, ক্ষোভে স্বজন হারানোর বেদনায় তারা মুখ খুলতে রাজি নয়।
আতাইকুলা গ্রামের শহীদ পরিবারের সদস্য গৌতম পাল জানান, স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক সময় অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বীরোত্ব গাঁথা এই গ্রামের শহীদ ও বীরাঙ্গনার পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নামের স্থান হয়নি। বড় পরিতাপের বিষয় যে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও এ দপ্তর সে দপ্তর ঘুরেও আমাদের কোনো একটা সুরাহা হলো না।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার এ্যাড. ইসমাইল হোসেন বলেন এই গ্রামের বীরাঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করার প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত দল সরেজমিনে তদন্ত করেছে। আমি আশা রাখি তদন্ত প্রতিবেদন কাউন্সিলে জমা হলেই তাদের নাম গেজেটভুক্ত করা হবে এবং তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে।
নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন এই গ্রামের বীরাঙ্গনাদের দ্রুত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ করবো। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বরাবর পাঠিয়েছি। আশা রাখি সরকার বিষয়টি সুদৃষ্টি সহকারে দেখবনে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম বলেন, বর্তমান প্রধান মন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। আতাইকুলা গ্রামের ১০বীরাঙ্গনার ব্যাপারে নিয়ম মাফিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাতে তারা তালিকাভূক্ত হতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।#
সতর্কীকরণ
সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।
কমেন্ট
নারী ও শিশু বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- অপরাজিতা ফেন্সি বানুর এগিয়ে চলার গল্প [ প্রকাশকাল : ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১২.০৫ অপরাহ্ন]
- আদিবাসীদের প্রতিনিধি টপ্পোর এগিয়ে চলার গল্প [ প্রকাশকাল : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০.০০ পুর্বাহ্ন]
- কালিয়াকৈরে বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে প্রেমিকা [ প্রকাশকাল : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০১.০০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে স্ত্রীর অভিযোগে স্বামী কারাগারে [ প্রকাশকাল : ১৫ আগস্ট ২০২৩ ০৫.০০ অপরাহ্ন]
- নওগাঁয় অপরাজিতা নেটওয়ার্কের কমিটি গঠন [ প্রকাশকাল : ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৪.০০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে যৌতুকের দাবীতে দ্বিতীয় স্ত্রীকে মারপিট [ প্রকাশকাল : ২২ জুলাই ২০২৩ ০১.১০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে মাতৃদুগ্ধ বিষযে অবহিতকরণ সভা [ প্রকাশকাল : ১৪ জুন ২০২৩ ০১.৩০ অপরাহ্ন]
- তজুমদ্দিনে ৩০ নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা [ প্রকাশকাল : ০৯ জুন ২০২৩ ০২.০০ পুর্বাহ্ন]
- রাণীনগরে মধ্যরাতে বাল্যবিয়ে বন্ধ করলেন ইউএনও [ প্রকাশকাল : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭.৩২ অপরাহ্ন]
- সিরাজগঞ্জে ব্যাগের ভিতর থেকে নবজাতক উদ্ধার [ প্রকাশকাল : ২৩ আগস্ট ২০২২ ০৪.১৭ অপরাহ্ন]
- রাণীনগর হাসপাতালে চালু হলো সিজারিয়ান কার্যক্রম [ প্রকাশকাল : ১১ আগস্ট ২০২২ ০৫.০৭ অপরাহ্ন]
- নওগাঁয় নির্যাতিতা গৃহবধূ শাপলার সংবাদ সম্মেলন [ প্রকাশকাল : ০১ আগস্ট ২০২২ ০৫.৫২ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে গৃহবধূর চুল কেটে নির্যাতন,আটক-৩ [ প্রকাশকাল : ১৮ জুলাই ২০২২ ০৫.৫০ অপরাহ্ন]
- সংগ্রামী জনপ্রতিনিধি খোদেজা খাতুন [ প্রকাশকাল : ০৭ জুলাই ২০২২ ০৫.৩০ অপরাহ্ন]
- হাসপাতালে জম্মের পর মৃত, বাড়িতে নেওয়ার পর কান্না [ প্রকাশকাল : ০৩ জুন ২০২২ ০৫.৩৩ অপরাহ্ন]