বিস্তারিত বিষয়
মান্দার পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রসূতিসেবায় অনন্য প্রতিষ্ঠান
মান্দার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রসূতিসেবায় অনন্য প্রতিষ্ঠান
[ভালুকা ডট কম : ০৭ মে]
গৃহবধূ নাসরিন বানু প্রসব ব্যথা নিয়ে ঢুকেছেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি কক্ষে। বাইরে বারান্দায় পায়চারি করছেন তার দিনমজুর স্বামী আতাউর রহমান। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়। নবজাতকের সেই কাঙ্খিত ক্রন্দনধ্বনি তার কানে ভেসে আসে। কক্ষের ভেতর থেকে তাদের নবজাতককে নিয়ে বের হয়ে আসেন এক নারী। শিশুটির মুখ দেখে আনন্দে চোখ ছলছল করে ওঠে আতাউরের।
আতাউর রহমানের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে। তিনি বলেন এই সন্তান প্রসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। রাজশাহীতে কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, স্বাভাবিক প্রসবে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা খরচ হবে। আর অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসবের জন্য গুনতে হবে অন্তত ২০ হাজার টাকা। পরে প্রতিবেশীদের পরামর্শে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই জন্ম হয় তাদের ছেলের।
আতাউর ও নাসরিন দম্পতির মতো বহু অসহায় মানুষের সহায় তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এখানে ২৪ ঘণ্টা প্রসূতিরা আসেন নিরাপদে সন্তান প্রসবের উদ্দেশ্যে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিনা খরচে সন্তান প্রসব শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান তারা। প্রসূতি সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় প্রতিষ্ঠানটি গত বছর সারা দেশে শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পুরস্কার পেয়েছে। এর আগে আরও আটবার দেশসেরা হয়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। ২০০৬ সাল থেকে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে।স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির এই ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন ওই কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) নাহিদ সুলতানা।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ মাসে এই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৭৫ জন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেছেন। গত মাসে ১১২ জন এবং জানুয়ারি মাসে ১১৮ জন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। গত বছর ১ হাজার ৭১৬ জন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেন। ২০০৮ থেকে গত বছর পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৫৭ জন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেছেন এখানে। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচজন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেন।
সরেজমিনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের বাইরে বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখা গেছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, একটি বড় কক্ষে ২০-২২ জন নারী বসে আছেন। কয়েকজন পুরুষও রয়েছেন সেখানে। সেবা নিতে আসা নারীদের কাছে সেখানকার সেবার মান কেমন, তা জানতে চাইলে প্রায় সবাই পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা ও আয়া আনোয়ারা বেগমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। জামেলা বেগম নামের এক নারী অতি উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলেন,সুলতানা ও আনোয়ারা আপার ব্যাপক হাতযশ। গর্ভবতী মায়েরা এখানে এলে আর কোনো ভয় থাকে না।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভেতরে আরেকটি কক্ষে দেখা গেল, পাশাপাশি দুটো শয্যায় শুয়ে আছেন দুই নারী। তাদের পাশেই সদ্যোজাত দুটি শিশুকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন তাদের স্বজনেরা। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওই দুটি শিশু এ দিন সকালেই ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জন্ম নিয়েছে। সেবা নিতে আসা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার শিহালয় গ্রামের কুরবান আলী বলেন, এখানকার সেবার মান খুবই ভালো। তার স্ত্রী লিমা আখতার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর আগের সন্তানও এখানেই জন্ম নেয়।
সেখানেই কথা হয় রাজশাহীর তানোর উপজেলার দিনমজুর আতাউর রহমানের সঙ্গে। সন্তান প্রসবের জন্য তার স্ত্রীকে নেওয়া হয়েছে পাশের কক্ষে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভেতর থেকে ভেসে আসে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। কয়েক মিনিট পরেই নতুন তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে সেই নবজাতককে নিয়ে হাসিমুখে বের হয়ে আসেন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা। আতাউরের উদ্দেশে বলেন, ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে। মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু।ওই মুহুর্তের অনুভূতি জানতে চাইলে নাহিদ সুলতানা বলেন, খুবই ভালো লাগছে। গর্ভের সন্তান সুস্থ্য ভাবে পৃথিবীতে এলে মা যেমন সব কষ্ট ভুলে যান, তেমনি আমার মনেও অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করি।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা বলেন, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে সেবা পাওয়া যায়, টাকা দিয়েও অনেক ক্লিনিক ও হাসপাতালে তা পাওয়া যায় না। এখানকার সুখ্যাতির জন্য মান্দা উপজেলার অন্য ইউনিয়নের মানুষ, পাশের নিয়ামতপুর উপজেলা, রাজশাহীর তানোর, মোহনপুর ও বাঘমারা উপজেলা থেকে লোকজন এখানে আসেন। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের একদম কাছেই। এ কারণে প্রসূতিরা সহজেই এখানে আসতে পারেন। আবার কোনো প্রসূতির সন্তান প্রসবে জটিলতা দেখা দিলে এখান থেকে দ্রুতই তাদের রাজশাহীতে নেওয়া সম্ভব হয়।
তিনি আরও বলেন, এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসূতি ও নবজাতকদের থাকার জন্য একটি ওয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হবে। খুব শিগগির এই কাজ শুরু হবে।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শক শফিকুর রহমান বলেন, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা ও তার স্বামী ওই কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (স্যাকমো) মোজাম্মেল হক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করেন। ফলে এই এলাকার প্রসূতি ও অন্য রোগীরা সার্বক্ষণিক তাদের এখানে পান। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উদ্যোগে এলাকার লোকজনকে নিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে গর্ভকালীন, প্রসবের সময় এবং প্রসবপরবর্তী সেবা নেওয়ার জন্য নিয়মিত সমাবেশ করা হয়।
নাহিদ সুলতানা বলেন, আমি ১৯৯৪ সালে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে নিয়ামতপুরের একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে যোগ দিই। ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে আছি। আমার চাকরি জীবনে ২০ হাজারের বেশি শিশুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে। আমার হাত ধরে এতগুলো শিশু পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে, মাঝে মাঝে এটা মনে করে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি আমার কাজকে কখনোই চাকরি মনে করি না। এটা আমার দায়িত্ব। যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, যখন শুনি কোনো রোগী জটিলতা নিয়ে এসেছে, তখন আর ঘরে থাকতে পারি না।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী পরিচালক ও ডিস্ট্রিক্ট কনসালট্যান্ট ডা. কামরুল আহসান বলেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির সাফল্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। প্রতি মাসে ১২০ থেকে ১৩০ জন প্রসূতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করানো সহজ কথা নয়। আমরা যখন অন্য কেন্দ্রে যাই তখন তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরি।
জেলা পরিবার ও পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক কুস্তরী আমিনা বলেন, তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি নওগাঁ ও রাজশাহীর সীমান্তবর্তী জায়গায় অবস্থিত। ওইখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনেক দূরে। ফলে ওই এলাকার মানুষ এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির ওপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেখানে কর্মরত স্বাস্থ্য পরিদর্শক, পরিদর্শিকা ও উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মানুষের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছেন। এ পর্যন্ত কেন্দ্রটি ৯ বার দেশসেরা হয়েছে। যা আমাদের গর্বের বিষয়।#
সতর্কীকরণ
সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।
কমেন্ট
নারী ও শিশু বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- অপরাজিতা ফেন্সি বানুর এগিয়ে চলার গল্প [ প্রকাশকাল : ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১২.০৫ অপরাহ্ন]
- আদিবাসীদের প্রতিনিধি টপ্পোর এগিয়ে চলার গল্প [ প্রকাশকাল : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০.০০ পুর্বাহ্ন]
- কালিয়াকৈরে বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে প্রেমিকা [ প্রকাশকাল : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০১.০০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে স্ত্রীর অভিযোগে স্বামী কারাগারে [ প্রকাশকাল : ১৫ আগস্ট ২০২৩ ০৫.০০ অপরাহ্ন]
- নওগাঁয় অপরাজিতা নেটওয়ার্কের কমিটি গঠন [ প্রকাশকাল : ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৪.০০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে যৌতুকের দাবীতে দ্বিতীয় স্ত্রীকে মারপিট [ প্রকাশকাল : ২২ জুলাই ২০২৩ ০১.১০ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে মাতৃদুগ্ধ বিষযে অবহিতকরণ সভা [ প্রকাশকাল : ১৪ জুন ২০২৩ ০১.৩০ অপরাহ্ন]
- তজুমদ্দিনে ৩০ নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা [ প্রকাশকাল : ০৯ জুন ২০২৩ ০২.০০ পুর্বাহ্ন]
- রাণীনগরে মধ্যরাতে বাল্যবিয়ে বন্ধ করলেন ইউএনও [ প্রকাশকাল : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭.৩২ অপরাহ্ন]
- সিরাজগঞ্জে ব্যাগের ভিতর থেকে নবজাতক উদ্ধার [ প্রকাশকাল : ২৩ আগস্ট ২০২২ ০৪.১৭ অপরাহ্ন]
- রাণীনগর হাসপাতালে চালু হলো সিজারিয়ান কার্যক্রম [ প্রকাশকাল : ১১ আগস্ট ২০২২ ০৫.০৭ অপরাহ্ন]
- নওগাঁয় নির্যাতিতা গৃহবধূ শাপলার সংবাদ সম্মেলন [ প্রকাশকাল : ০১ আগস্ট ২০২২ ০৫.৫২ অপরাহ্ন]
- রাণীনগরে গৃহবধূর চুল কেটে নির্যাতন,আটক-৩ [ প্রকাশকাল : ১৮ জুলাই ২০২২ ০৫.৫০ অপরাহ্ন]
- সংগ্রামী জনপ্রতিনিধি খোদেজা খাতুন [ প্রকাশকাল : ০৭ জুলাই ২০২২ ০৫.৩০ অপরাহ্ন]
- হাসপাতালে জম্মের পর মৃত, বাড়িতে নেওয়ার পর কান্না [ প্রকাশকাল : ০৩ জুন ২০২২ ০৫.৩৩ অপরাহ্ন]