তারিখ : ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

সখীপুরে ১৪ মৌজায় ভূমি নিয়ে জটিলতা

সখীপুরে ১৪ মৌজায় ভূমি নিয়ে জটিলতা ,নামজারি না হওয়ায় বৈধ উপায়ে জমি বিক্রি বন্ধ
[ভালুকা ডট কম : ২৭ মে]
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ১৪টি মৌজায় প্রজা (ভূমি মালিক) খাজনা দিতে চায় কিন্তু স্থানীয় ভূমি কার্যালয় (রাজা) খাজনা নিচ্ছে না। উপজেলার কমপক্ষে এক লাখ মানুষ তাদের শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির গত ২১ বছর ধরে খাজনা দিতে পারছে না।জমির নামজারি না হওয়ায় বৈধপ্রক্রিয়ায় (রেজিস্ট্রি করে) ক্রয়-বিক্রয়ও করতে পারছে না। ফলে সকল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সখীপুরে কোনো কলকারখানা গড়ে উঠতে পারছে না।

সখীপুরে প্রশিকা, গ্রামীণ প্রযুক্তি, বুরো-বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা জমি কিনে সেখানে বহুতল ভবন করে বিপদে পড়েছেন। প্রতিবছরই ওইসব সংস্থাকে ওইসব বহুতল ভবন সরিয়ে নিতে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় নোটিশ দিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ব্যক্তিমালিকাধীন জমির মালিকদের পাশাপাশি সংস্থার মালিকরাও বিপদে ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সখীপুর উপজেলার গড়গোবিন্দপুর, সখীপুর, প্রতিমাবংকী, লাংগুলিয়া, বেড়বাড়ি, রতনপুর, হাতিবান্ধা, হতেয়া, বাজাইল, কালমেঘা  দেওয়ানপুর, কালমেঘা আতিয়া, কালমেঘা তালেপাবাদ, চতলবাইদ ও বহুরিয়া চতলবাইদ এ ১৪টি মৌজার জমির খাজনা দেওয়ার দাবিতে উপজেলায় ভূমি মালিকদের নিয়ে প্রায় দেড়যুগ আগে একটি আন্দোলন কমিটিও গঠিত হয়েছে। ওই কমিটি নানা আন্দোলন সংগ্রাম করেছে।

নিজ এলাকায় হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালনের পর সর্বশেষ গত ২০১৭ সালের ২২ মে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। এ ধরনের বড় কর্মসূচির খবর পেয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাস দিলে আন্দোলন থেমে যায়। এরমধ্যেই ওই জেলা প্রশাসক বদলি হয়ে যান। এরপর ওই বছরের ৩১ জুলাই নতুন জেলা প্রশাসক খান নুরুল আমিনের সঙ্গে আন্দোলনকারীরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও সখীপুর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য-সচিব করে জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা, টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, ভূমি মালিকদের পক্ষে আন্দোলনরত ভূমির অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, (বর্তমানে টাঙ্গাইল-৮ আসনের সাংসদ)  উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুতুব উদ্দিন, তৎকালীন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত শিকদার ও সখীপুর পৌরসভার মেয়র আবু হানিফ আজাদসহ নয় সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এরপর ওই কমিটি কয়েকদফা বৈঠক করলেও ভূমির জটিলতা নিরসনে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সূত্র দাবি করে ভূমি মালিকদের দাবির পক্ষের প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এরআগে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আন্দোলনকারীরা সখীপুর থেকে ঢাকা শহরে গিয়ে মহানগর নাট্যমঞ্চে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে। ওই কর্মসূচিতে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা অনশনকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙান। ওই ঘটনার পর থেকে আন্দোলন থেমে যায়। ওই মন্ত্রীর কথা দেওয়ার সাত বছর পার হলেও খাজনা নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে আর কোনো নতুন সিদ্ধান্ত স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসেনি।

সখীপুর ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ওই ১৪টি মৌজায় ১৯৭৬-১৯৮৫ সালে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরএস (রিভাইজড সার্ভে) জরিপ সম্পন্ন হয়। এরপর ভূমি মালিকদের বরাবর নকশা ও পরচা দেওয়া হয়। ১৪ মৌজার মধ্যে প্রথমে আটটি মৌজার ভলিউম স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসে এবং খাজনা আদায়ের জন্য নির্দেশও আসে। ওই সময় (১৯৯৮ সাল) বন বিভাগ তাদের কিছু জমি ওই রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দাবি করে বন বিভাগ আপত্তি দিলে স্থানীয় ভূমি অফিস খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে দীর্ঘ ২১ বছর পার হলেও আর খাজনা নেওয়া হয়নি। ১৪ মৌজার খাজনা আদায় না হওয়ায় সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূমির মালিকেরা তাঁদের দখলীয় জমি বিক্রি করতে পারছেন না, এমনকি ওই জমির বিপরীতে কোনো ব্যাংক ঋণও নিতে পারছেন না। নামজারি না হওয়ায় বৈধভাবে জমি কেনাবেচাও করতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়েই জমির মালিকরা ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বৈধভাবে জমি নিবন্ধন ( রেজিস্ট্রি) না হওয়ায় শিল্পপতিরা এ অঞ্চলে জমি কিনছেন না। ফলে এ এলাকায় কোনো মিলকারখানা গড়ে উঠছে না।

বুরো-বাংলাদেশ সখীপুর শাখার ব্যবস্থাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৯৬ সালে আমাদের এনজিও নিজনামে গড়গোবিন্দপুর মৌজায় ৩৩ শতাংশ জমি কেনে। ২০১০ সাল পর্যন্ত খাজনাও পরিশোধ করা হয়। ওই জমিতে পাঁচবছর ধরে ছয়তলা বিশাল ভবন নির্মাণও করা হয়েছে। মাসখানেক আগে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় থেকে ওই ভবন সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে একটি নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

সখীপুর প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. রতন মিয়া বলেন, প্রশিকা আজ থেকে ৩০ বছর আগে প্রথমে ১০ শতাংশ ও পরের বছর ৬০ শতাংশ জমি কিনে পাকা ভবন করে কার্যালয় বানিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ওই জমির ২০১০ সাল পর্যন্ত খাজনা নিলেও পরে আর নিচ্ছে না। মাসখানেক আগে আমাদের কোনো নোটিশ না দিয়ে সীমানা প্রাচীরের ভেতর পৌরভূমি কার্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান লিখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশিকার পাশেই মর্ডার্ন হসপিটাল নামের একটি পাঁচতলার বেসরকারি হাসপাতালকে সরিয়ে নেওয়ার নোটিশ দিয়েছে ভূমি কার্যালয়।

এ ব্যাপারে সখীপুর ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক  বলেন, শিগগিরই আটিয়া বন অধ্যাদেশ-৮২ বাতিল হচ্ছে। ওই অধ্যাদেশ বাতিল হলে কিছুটা হলেও ভূমি মালিকদের উপকার হবে। এ সমস্যা নিয়ে আগেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। এবার আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা চলছে। যে পর্যন্ত খাজনা নেওয়া না হবে, সে পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না।

গড়গোবিন্দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ হাবিব বলেন, ১০০ থেকে ১৫০ বছর ধরে ভোগ দখল করলেও খাজনা না নেওয়ায় আমরা আমাদের জমি চাষাবাদ করতে পারছি ঠিকই কিন্তু জমি বৈধভাবে বিক্রি ও ব্যাংকঋণ তুলতে পারছি না। আমরা নিজ ভূমিতেও পরবাসী হয়ে আছি।

আন্দোলন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জুলফিকার হায়দার কামাল বলেন, জমিগুলোর খাজনা না নেওয়ায়, জমি নিবন্ধন না করতে পেরে বাধ্য হয়ে জমি মালিকেরা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জমি কেনাবেচা ঠিকই করছে। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে  জমির নামজারি ও সাবরেজিষ্ট্রি মূলে বিক্রি না হওয়ায় ঢাকা শহরের কাছে হওয়ার পরও  এ অঞ্চলে কোনো কারখানা গড়ে উঠছে না। খাজনা নেওয়ার বিষয়ে আবারও আন্দোলনে নামার চিন্তাভাবনা করছি।

এ প্রসঙ্গে সখীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আয়শা জান্নাত তাহেরা বলেন, সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা থাকায় আর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না আসায় আমরা ভূমি উন্নয়ন কর নিতে পারছি না।

সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুর রহমান বলেন, সখীপুরে একই জমিতে বনবিভাগ, ভূমি অফিস ও ভূমি মালিকদের দাবি থাকায় ও সীমানা নির্ধারণ (ডিমারগেশন) না থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন দরকার বনবিভাগ ও ভূমি কার্যালয়ের যৌথজরিপ। জরিপছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম বলেন, ১৪ মৌজার খাজনা সমস্যা নিয়ে ও এর নিরসনে আমি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সুস্পষ্টভাবে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৬ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই