তারিখ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

বিজয়ের ৪৮ বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি মুক্তিযোদ্ধার

বিজয়ের ৪৮ বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি,যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আহাম্মদ আলীর
[ভালুকা ডট কম : ১৮ ডিসেম্বর]
অধিকার আদায়ে বীরদর্পে গর্জে ওঠা আর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙ্গালি জাতির পুরনো ইতিহাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর  বিরুদ্ধে আন্দোলন ও যুদ্ধে মেতে উঠেছিলেন বাঙালিরা। ওই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নের আউলটিয়া গ্রামের মৃত নঈম উদ্দিন আকন্দের ছেলে আহাম্মদ আলী ওরফে জবেদ(৬৮)। কিন্ত বিজয়ের ৪৮ বছরেও রণাঙ্গনে গুলিবিদ্ধ আহাম্মদ আলীর ভাগ্যে মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের আউলটিয়া গ্রামের মৃত নঈম উদ্দিন আকন্দের ছেলে আহাম্মদ আলী ওরফে জবেদ ১৯৭০ সালে ত্রিশাল নজরুল ডিগ্রি কলেজ থেকে একাদশ ১মবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের বিরিশিরি পিটি ইনস্টিটিউটে ১৯৭০-৭১ সেশনে ভর্তি হন। দুর্গাপুরের বারমারীতে এক বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশুনা করতেন তিনি। একাত্তুরের মার্চ মাসের প্রথম দিকেই শেষ হয় আহাম্মদ আলীর পিটিআই কোর্স। এরইমধ্যে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না উঠতেই দেশের সবক’টি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে পাক-হানাদার বাহিনী ফেরা হয়নি নিজগ্রামে।

বয়সের ভারে নুয়েপড়া ৬৮ বছর বয়সি শারীরিকভাবে অসুস্থ আহাম্মদ আলীর সঙ্গে যুদ্ধকালীন সময়ের গল্প জানতে গেলে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান, একাত্তুরের ৩০ এপ্রিল সর্বপ্রথম পাক-বাহিনী দুর্গাপুর সদরে প্রবেশ করেছিল। পরে রাজাকারদের সহযোগিতায় দুর্গাপুরের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায় হানাদাররা। আগুনে পুড়িয়ে দেয় মানুষের ঘরবাড়ি। বিরিশিরি পিটি ইন্সটিটিউটসহ খ্রিষ্টান ব্যাপিস্ট মিশন কম্পাউন্টে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী গড়ে তোলে তাদের ক্যাম্প।

মুক্তিকামী বাঙালিরা বারমারি বিডিআর ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিচ্ছে, এমন খবরে পাক-হানাদাররা ওই ক্যাম্পে আক্রমন চালিয়ে ক্যাম্পটি তাদের দখলে নেয়। বারমারি বিডিআর ক্যাম্পের সুবেদার আজিজুল হক নিরস্ত্র মুক্তিকামী বাঙালিদের নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা রংরা বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে আশ্রয় নেন। শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সেখানেই প্রশিক্ষন শিবির গড়ে তোলেন।

দেশকে হানাদার মুক্ত করতে বারমারি বিডিআর ক্যাম্পের সুবেদার আজিজুল হকের কাছে প্রশিক্ষনের জন্য যান ত্রিশালের আউলটিয়া গ্রামের আহাম্মদ আলী ওরফে জবেদ। রংরায় শুরু করেন প্রশিক্ষন। প্রশিক্ষনকালীন ও যুদ্ধ চলাকালে অধিকাংশ সময় আহাম্মদ আলী ‘মুক্তিবাহিনীর (সিকিউরিটি ব্রান্স) নিরাপত্তা শাখায় দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর আগস্টে তিনি প্রথম ১১নং সেক্টরের কমান্ডার হামিদ উল্লাহ খানের অধিনে সম্মূখযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। লক্ষীপুর গ্রামে অবস্থান করে আহাম্মদ আলীসহ ২০/২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা চন্ডিগড়, মায়ানগর, জারিয়ায় এলাকায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রায় দেড়-দুইঘন্টা স্থায়ী ওই সম্মূখযুদ্ধে পাল্টাপাল্টি গুলিগুলির পর পিছু হটে হানাদার বাহিনী।

৩ ডিসেম্বর দুপুর একটার দিকে সিগন্যাল ফায়ার পেয়ে মুক্তিবাহিনীর ৪টি টিম একত্রিত হয়ে মেনকি ফান্দা, নন্দননগর, শ্যামনগর ও লক্ষীপুর এলাকাজুড়ে উঁৎপেতে থাকা হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমন চালায়। ওই যুদ্ধেও অংশ নেয় আহাম্মদ আলী। পাক-ঘাঁটি লক্ষ্য করে নিক্ষেপের জন্য আহাম্মদ আলীর কাছে ছিল ৫টি গ্রেনেড। জীবন বাজি রেখে ঘাঁটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু পাকবাহিনীর ব্রাসফায়ারের কারনে গ্রেনেড নিক্ষেপের আগেই গুলিবিদ্ধ হন আহাম্মদ আলী। টানা চারঘন্টা চলে ওই সম্মূখযুদ্ধটি। পিছুহটে হানাদাররা।

পরে গুলিবিদ্ধ হন আহাম্মদ আলীকে নায়েক সুবেদার হাফিজুর রহমান, হাবিলদার মেজর আব্দুর রাজ্জাকসহ সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান দাম্বুক এমএফ ক্যাম্পে। সেখান থেকে ফান্দা সিআরপি ক্যাম্পে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ফান্দায় সারারাত কাটান তিনি। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের সহায়তায় সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাঘমারা হাসপাতালে। প্রচুর রক্তক্ষরনের ফলে সেখানে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ৬ ডিসেম্বর বিএসএফ ক্যাপ্টেন মোরারির সহায়তায় আহাম্মদ আলীকে ভর্তি করা হয় তোরা সিভিল সার্জন হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে ১১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৭ ডিসেম্বর রিলিজ হয় তার। আহাম্মদ আলী দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই স্বাধীন বাংলার আকাশে উড়ছিলো লাল সবুজের পতাকা। মাতৃভূমি স্বাধীন ভূ-খন্ডে উপনিত হওয়ার বুকভরা আনন্দে দুর্গাপুরে ফিরলেও দেখা হয়নি কোন সহযোদ্ধার সঙ্গে।

দুর্গাপুরে ফিরে ইউনিয়ন রিলিফ কমিটিতে যোগদান করে রিলিফ বন্টন ও স্বরনার্থীদের পুণর্বাসন কাজে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বারমারী গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আহাম্ম আলী। ১৯৭৩ সালে বারমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করে সরকার। ১৯৮২ সালে তিনি বদলি হয়ে চলে আসেন নিজ উপজেলার চকরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে যান ২০০৯ সালে।

আহাম্মদ আলীর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত না হওয়ায় ২০০০ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন তিনি। ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি বাদপড়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে আহাম্মদ আলীকে তালিকাভূক্ত করেন। থানা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য-সচিব মোজাহিদ খান ভোলাসহ জেলা ও থানা সভাপতির স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকলেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি তিনি।

বিজয়ের ৪৮ বছরে পদার্পণ করে রণাঙ্গনের সেই গুলিবিদ্ধ আহাম্মদ আলী মুক্তিযোদ্ধের স্বীকৃতি না পেয়ে, নিজেকে শান্তনা দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী ওই গানটি শুনেন “এক নদী রক্ত পেরিয়ে.........“হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে, তোমাদের কথা কেউ কবে না। তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা, তোমাদের এই ঋন কোনদিন শোধ হবে না”।

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত আহাম্মদ আলী বলেন, জীবন বাজী রেখে যুদ্ধে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে ২০০০ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেও মেলেনি স্বীকৃতি। মাঝেমধ্যে নিজের মনকে শান্তনাদিতে মুক্তিযুদ্ধের  গানগুলি শুনি।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

পাঠক মতামত বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই