তারিখ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

স্বীকৃতি ছাড়াই চলে গেলেন না ফেরার দেশে ১৯ ভাষা সৈনিক

ময়মনসিংহের উত্তর জনপদের
স্বীকৃতি ছাড়াই চলে গেলেন না ফেরার দেশে ১৯ ভাষা সৈনিক
[ভালুকা ডট কম : ১৩ ফেব্রুয়ারী]
ময়মনসিংহের উত্তর জনপদ গৌরীপুর, শ্যামগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ, আঠারোবাড়ী, ফুলপুর,পূর্বধলা এলাকার পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে যে ১৯ জনের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়েছিল সেই সৈনিকদের কথা কেউ জানে না বা মনে রাখেনি। তাছাড়া দীর্ঘ সময়েও তাদের স্বরন করেনি কেউ।  সময়ের আবর্তে তারা একে একে সবাই চলে গেছে না ফেরার দেশে।

মায়ের ভাষা প্রতিষ্টা করতে আজ থেকে ৬৩ বছর আগে প্রত্যন্ত এ গ্রামীন জনপদে মরনপণ করে যারা আন্দোলন করেছেন তারা অনেকেই দেখে যেতে পারেননি বাঙ্গালীর মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর তাদের অবদানের মুল্যায়নের ঐতিহাসিক শুভক্ষনটি। ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানী প্রথমসারির নেতৃত্বদানকারী ১৯ ভাষা সৈনিকের মাঝে বর্তমানে কেউ বেঁচে নেই। এ অঞ্চলের বেঁচে থাকা সর্বশেষ ভাষা সৈনিক আশুতোষ রায় (৮২) ২০১৩ সনের ২৩ জানুয়ারী মারা গেছেন। জীবিত আশুতোষের রায়ের আশা ছিল মরনের আগে যেন  তিনি ও তার অন্যান্য মৃত সহযোদ্ধারা এতটুকু সরকারী স্বীকৃতি পায়। কিন্তু শেষ-মেষ সে আশাও পূরণ হয়নি তার।

১৯৫২সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকেই এ অঞ্চলে তৎকালীন ঈশ্বরগঞ্জ থানার অধীনে গৌরীপুর ছিল আন্দোলনের মুল কেন্দ্রস্থল। গৌরীপুর  থেকেই পরিচালিত হতো  আন্দোলনের সকল সাংগঠনিক কর্ম পদ্ধতি ও রূপরেখা। কেন্দীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে ময়মনসিংহের ভাষা সৈনিক রফিক উদ্দিন ভূঞা এমপি,সামছুল হক এমপি, হাতেম আলী এমসি’র নেতৃত্বে গৌরীপুর আরকে হাইস্কুল, গৌরীপুর রামগোপালপুর পি, জে, কে হাইস্কুল, গৌরীপুর শ্যামগঞ্জ হাইস্কুল, ঈশ্বরগঞ্জ চরনিলক্ষিযা উচ্চ বিদ্যালয়, ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করে ভাষার দাবীতে প্রতিদিন মিছিল-মিটিং, পথসভা, পোষ্টারিং, লিফলেট বিতরণ,ধর্মঘটসহ নানমুখী আন্দোলন চালানো হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে গৌরীপুর ও ঈশ্বগঞ্জের ১৯ নেতার নামে তৎকালীন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকার হুলিয়া জারি করেছিল।

তারা হলেন গৌরীপুরের কৃষক প্রজা পার্টির নেতা আঃ ওয়াহেদ বোকাইনগরী এম,এল,এ (মৃত),আঃ কদ্দুছ বোকাইনগরী (মৃত),জমশেদ আলী (মৃত),,আওয়ামী মুসলিমলীগ সভাপতি খালেদুজ্জামান (মৃত),হাতেম আলী মিয়া এম,সি,এ (মৃত), ছাত্রলীগ নেতা ড্াঃ এম,এ সোবহান, (মৃত) আব্দুস সামাদ (মৃত),হায়দার আলী, (মৃত),আমির উদ্দিন (মৃত),ছফির উদ্দিন (মৃত), শ্যামগঞ্জের মোজাহের উদ্দিন (মৃত),বিড়ি শ্রমিক নেতা ইসমাইল হোসেন (মৃত), সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইসহাক উদ্দিন ফকির(মৃত),কম্যুনিষ্ট নেতা মোঃ আবুল হোসেন (মৃত), জাতীয় কংগ্রেসের দপ্তর সম্পাদক আশুতোষ রায়  (মৃত) ও ঈশ্বরগঞ্জের মুসলেমউদ্দিন খান (মৃত) , সদর মহকুমার আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আঃ আজিজ মন্ডল (মৃত),আঠারবাড়ীর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান (মৃত) প্রমুখ হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে গ্রামের হাটবাজারে টিনের চোঙা ফুকিয়ে পথসভা,সমাবেশ চালিয়ে গেছেন।

এ সময় ভাষা সৈনিকরা কখনো পায়ে হেটে,বা কখনো গরু গাড়ী করে অতিকষ্টে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আন্দোলনের সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়েছেন। ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্র-জনতার মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর বর্ররতার খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর পরেই ওইদিন বিকালে গৌরীপুরের ছাত্র-জনতা এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে। ২৩ ফেব্রুয়ারী গৌরীপুরে ধর্মঘটের ডাক দিলে স্থানীয় আর,কে হাইস্কুলের ছাত্ররা গৌরীপুর-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করে রাখে। খবর পেয়ে ময়মনসিংহের দাঙ্গা পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে রেলপথ মুক্ত করে। এর পর ফেব্রুয়ারীর ২৮-২৯ তারিখে গৌরীপুরের তৎকালীন বাজার ময়দানে (বর্তমানে শহীদ হারুন পার্ক) ইটের পর ইট স্থাপন করে সালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু পরক্ষনেই পুলিশ ছুটে এসে তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। এরকম ২দিন একই ঘটনা ঘটায় পুলিশ বাহিনী। এ সময় গৌরীপুরের এম,সি,এ হাতেম আলী মিয়া,খালেদুজ্জামান,আঃ কদ্দুছ বোকাইনগরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রায় ৯ মাস কারাভোগের পর তাদের মুক্তি মিলে।

বেঁচে থাকতে ঈশ্বরগঞ্জের ভাষা সৈনিক মুসলেহ উদ্দিন খান (৯৯) জাানিয়েছিলেন, ময়মনসিংহ জেলার নাসিরাবাদ হাই মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে । তখন মনসুর আহম্মদকে সভাপতি ও রফিক উদ্দিন ভুইয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, তিনিও এ কমিটির সদস্য ছিলেন । ১৯৫২ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ময়মনসিংহ শহরের বিপিনপার্কে সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্টিত হয় । ওই দিন বিপিন পার্কে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডিবি পুলিশ লাল খা‘র নেতৃত্বে একটি দল মুসলেহ উদ্দিন খানকে গ্রেফতার করে । এ সময় আরো গ্রেফতার হয় সভাপতি মনসুর আহাম্মদ, সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিক উদ্দিন ভুইয়া, মোঃ হাসিম উদ্দিন ও আব্দুল আজিজ । পরের দিন সকলকে কারাগারে পাঠানো হয় । মুসলেম উদ্দিন জেল থেকেই শুনতে পেলেন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে । এতে সালাম ,রফিক, জব্বার বরকতসহ অনেকেই মারা গেছেন । প্রতিবাদে ময়মনসিংহ শহর কাপঁছিল । এর উত্তাপ জেল খানায় বসেই  পাচ্ছিলেন তারা । ৫ মাস কারাভোগের পর ১৯৫২ সালের জুনে জেল থেকে ছাড়া পায় মোসলেম উদ্দিন । মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ভাষাসৈনিক মুসলেহ উদ্দিন । ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনী তার বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয় ।

জীবিত কালে গৌরীপুরের ভাষা সৈনিক  ডাঃ এম এ সোবহান ও মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ রায় স্মৃতিচারণ করে  বলেছিলেন হুলিয়া  মাথায় নিয়ে ভাষার দাবীতে এ অঞ্চলে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল আমরা ২ জন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই- আমরাও মত্যুর দ্বার প্রান্তে এসে দাঁঁিড়য়েছি।

ওইসময় তারা অত্যন্ত আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ঢাকার কেন্দ্রীয় ভাষা সৈনিকদের মুল্যায়ন হলেও গৌরীপুরসহ এ অঞ্চলের ভাষা সৈনিকরা বরাবরই অমুল্যায়িত থেকে গেছে। বেঁচে থাকতে তাদের একমাত্র আশা ছিল জীবিত থাকা অবস্থায় যেন এতটুকু মুল্যায়ন দেখে যেন মরতে পারেন। কিন্তু জীবিতকালীন  ১৯ ভাষা সৈনিকের কেউ দেখে যেতে পারেননি  সরকারীভাবে তাদের  স্বীকৃতির  শুভক্ষনটি। এর পরও এলাকাবাসীর আশা দীর্ঘদিন পরে হলেও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠাকারী মৃতের দেশে চলে যাওয়া এ অঞ্চলের ১৯ ভাষা সৈনিকদের সন্তান-সন্তোতীরা যেন তাদের পিতা-বা অভিভাবকদের সঠিক মুল্যায়ন দেখে যেতে পারে। #



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অন্যান্য বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই