তারিখ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

মজুরি বৈষম্যের শিকার শুটকি চাতাল-কন্যারা

পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় মজুরি অর্ধেকেরও কম
মজুরি বৈষম্যের শিকার শুটকি চাতাল-কন্যারা
[ভালুকা ডট কম : ১৪ নভেম্বর]
তখনো ভোর হয়নি। কাটেনি ফযর আযানের রেশ। টানা পায়ে হাঁটছে রাহেলা মহিষলুটির শুটকি চাতালের দিকে। হয়তো মাছ নামানো শুরু হয়ে গেছে। আজ একটু দেরি হয়ে গেছে তার। নলুয়াকান্দি গ্রাম থেকে প্রায় দুই ক্রোশ পথ মহিষলুটির শুটকির চাতাল। তাই আরো টানা পায়ে এক রকম দৌড়ের মত করে হাঁটতে থাকে সে। তারা ৭ জন নারী শ্রমিক কাজ করেন ঐ চাতালে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বৃহৎ মাছের আড়তের অদুরে নান্নু মিয়ার শুটকির চাতাল। সে দলনেত্রী, অপর ৬ জনের কাজের তদারকি করতে হয় তাকে। তাড়াশ উপজেলার নলুয়াকান্দি ও পংরৌহালী গ্রামের মোট ৭ জন নারী রাহেলা, ফিরোজা, জমিরণ, মইফুল, অজেদা, পারভীন ও সাজেদা কাজ করেন ঐ শুটকির চাতালে। ওরা সবাই হয়তো এসে পড়েছে। আজ চাতালের মহাজনের বকুনি আছে তার ভাগ্যে। ভাবতে ভাবতে রাহেলা এসে পৌঁছায় মহিষলুটির শুটকি চাতালে। ততক্ষণে মাছ নেমে গেছে। সহকর্মীদের সাথে নিয়ে নিত্য দিনের মতই চাতালের মাচায় মাছ ছড়িয়ে দিতে থাকে রাহেলা। পুঁটি, খলিশা, টেংরা, চেলা, ঢেলা, কাকিলা, চাপিলা ও মোয়া মাছ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথায় কথায় রাহেলা জানায়- ছোট ছোট এক ছেলে এক মেয়ে রেখে তার স্বামী মারা গেছেন ৮/৯ বছর আগে। অর্থাভাবে ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা করাতে পারেন নি। তারা পরের বাড়ি পেটে ভাতে কাজ করে। এখান থেকে যা পায় তাতে তাদের তিন জনের খাওয়া পড়া হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে রাহেলা বলেন- মজুরি কম হলিও এ কাম না কোর‌্যা কী হরবো। খাবো কী?

চাতালের মহাজন নান্নু মিয়া। তার বাড়ি নাটোর জেলার গুরুদাসপুরে। সাংবাদিকদের দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে নান্নু মিয়া বলেন- এহন তো কামের হোময়। এমনিতি ছোট দিনের বেল (বেলা)। আপনাগোরে সাথে কতা কলি কাম করবো কহন?  আমরা বললাম ভাই বেশি সময় নেবো না। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তিনি বলেন- “লাভ কী হবো ছার, কত টিপি চেনেল, কত পরতিকার সামবাদিক আইলো, ফোটু তুললো। আমাগরে যে আবস্থা সেই আবস্থাই রয়্যা গ্যালো।”

অনেক বুঝিয়ে তার সাথে কথা বলে জানা গেল- তিন কেজি টাটকা মাছে এক কেজি শুটকি তৈরি হয়। আগের মত আর মাছ নেই চলনবিলে। তাই শুটকিও আর বেশি হয় না। ৫-৬ বছর আগেও নান্নু মিয়ার চাতালে কাজ করতো ১৫-১৬ জন নারী ও ৭-৮ জন পুরুষ শ্রমিক। আবহাওয়া ভাল থাকলে প্রতি মৌসুমে চাতাল চলে আশ্বিণ-কার্তিক মাস থেকে মাঘ-ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি শুটকি মাছ বিক্রি হয় ৩৭০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা।

চলনবিলের বৃহৎ পাইকারি মাছের বাজার সিরাজগঞ্জ জেলার মহিষলুটির আশে পাশে ৬টি শুটকির চাতালে কাজ করেন অর্ধশত পুরুষ ও অন্তত: দেড়শতাধিক নারী শ্রমিক (চাতাল কন্যা)। উল্লাপাড়া উপজেলার লাহীড়ি মোহনপুর এলাকায়  হবি শেখ, সাচ্চু মিয়া ও বরাত আলীর শুটকির চাতালসহ মোট ৫টি চাতালে কাজ করছেন প্রায় শতাধিক শ্রমিক। এদের মধ্যে ৬০ জনই নারী শ্রমিক। নাটোরের সিংড়া উপজেলার নিংগইন গ্রামে রজব আলীর শুটকির চাতালে কাজ করেন ৩২ জন নারী ও ১১ জন পুরুষ শ্রমিক। বিলদহর ও ডাহিয়া গ্রামে এরশাদ ও আবুল খায়েরের চাতালে কাজ করেন মোট ১৩ জন নারী ও ৬ জন পুরুষ শ্রমিক। এসব চাতালে কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন কাজ করে নারী শ্রমিকেরা মজুরি প্রায় মাত্র ১৫০ টাকা। আর পুরুষ শ্রমিকেরা পায় ‘তবাক খরচসহ’ (তামাক-বিড়ি) ৩৫০ টাকা।  চাতালে কর্মরত শ্রমিক ও মহাজনদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানাগেছে ।

শুটকি শ্রমিকেরা জানান- টাটকা মাছ মাপজোখের পর মাখানো হয় লবণ। লবণ মাখানো হলেই কাঁখে করে নারী শ্রমিকেরা নিয়ে যায় মাচায়। সেখানে মাছগুলো সুন্দর করে বিছিয়ে রোদমুখী করা হয়। তারপর সারাদিন কয়েকবার উল্টে-পাল্টে দেওয়া হয়। আর এসব কাজই হয় নারী শ্রমিকের হাতে। মহাজন কেবল মাছ কিনেই দায়মুক্ত। রোদ মৃদু থাকলে শুকাতে লাগে তিন-চার দিন। আর রোদ চড়া থাকলে একদিনেই শুটকি হয়ে যায়। বড় কিছু কিছু মাছে একটু বেশি সময় লাগে।

মহাজনেরা জানান- মাছ শুঁটকি শেষে এ,বি ও সি গ্রেডে বাছাই করা হয়।  ‘এ’  ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের ২৫টি দেশে রফতানি করা হয়। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে চলনবিলের সুস্বাদু শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া  ‘সি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।

ভোজন রসিকদের কাছে শুটকি মাছ একটি সুস্বাদু ও লোভনীয় আমিষ জাতীয় খাদ্য। আর সেটা যদি চলনবিলের শুটকি হয় তবে তো কথাই নেই। কেননা চলনবিলের মিঠা পানির মাছ প্রাকৃতিক ভাবেই সুস্বাদু। আর সেই মাছ যখন সূর্যের তপ্তরোদে ভাজা (শুকানো) হয় তখন বাড়তি স্বাদ এসে যোগ হয় সেই শুটকিতে।  চাতাল থেকেই এসব শুটকি মাছ নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা রফতানি করেন বিভিন্ন দেশে।

চলনবিলে রয়েছে মোট প্রায় ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৯৩টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ৩২ টি নদী ও ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল এবং অসংখ্য বড় বড় পুকুর জলাশয়। এই বিল এলাকায় ৩ জেলা সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের ১০ উপজেলার কয়েক হাজার নারী শ্রমিকের হাতের ‘জাদুর’ তৈরি চলনবিলের শুঁটকি যাচ্ছে দেশ-বিদেশে। যাদের হাতের জাদু পরশে চলনবিলের শুটকি মাছের এত কদর। তাদেরই কোন কদর নেই। তারা নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, উপরন্তু নানা প্রকার কটু কথা দুর্ব্যবহার সহ্য করেই কাজ করতে হয় মহাজনের চাতালে। এদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। নারী শ্রমিকের মজুরি বিষয়ে কথা বলতে গেলে চাতাল মালিকেরা নানা ভাবে দায়সারা জবাবে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

এব্যাপারে নাটোরের এনজিও সংস্থা পল্লী কল্যাণ শিক্ষা সোসাইটি (পিকেএসএস) এর নির্বাহী পরিচালক ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের স্থানীয় নেত্রী ডেইজি আহমেদ বলেন- তিনি চাতাল মালিকদের সাথে কথা বলবেন এবং  মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকদের সঠিক মজুরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদেরকে সমবেত করে প্রয়োজনে স্থানীয় এমপিদের নিকট বিষয়টি তুলে ধরবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইত্তেফাককে বলেন- চলনবিলে নদ-নদী খাল বিলে সারা বছর পানি সংরক্ষণের জন্য স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহের মাধ্যমে বিল ও নদী খনন করতে হবে। বিলে নাব্যতা ফিরে এলে- মাছ হবে, পাখি আসবে, খাদ্য শস্যের নির্বিঘ্ন চাষাবাদ হবে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।  #



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

নারী ও শিশু বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই