তারিখ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

ভালুকার পাল সম্প্রদায়ের মৃৎ শিল্প বিলুপ্তির পথে

ভালুকার পাল সম্প্রদায়ের মৃৎ শিল্প বিলুপ্তির পথে
[ভালুকা ডট কম : ২৯ ডিসেম্বর]
এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিয্য মাটির তৈজসপত্র নির্মানকারী মৃৎ শিল্পী পাল সম্প্রদায়ের আয় রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের জীবনে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। বিজ্ঞানের আধুনিকায়ন ও উন্নত প্রযুক্তির তৈরী দীর্ঘস্থায়ী বাসনপত্র ও সামগ্রীর কাছে মাটির তৈরী ঠুনকো জিনিষ এখন আর মানুষের নজরে লাগেনা। তার পরও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মাটির তৈরী হাড়ি পাতিলের প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি বলে এখনও পাল সম্প্রদায়ের অনেকে সাত পুরুষের আদি পেশা জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ধরে রেখেছেন।

উপজেলার মল্লিকবাড়ী বাজার সংলগ্ন অনেক পুরোনো পালপাড়া। যেখানে দিনভর চলতো মাটিগুলে বাসনপত্র তৈরীর কাজ। মাটি নরম করা, চাকা ঘুড়িয়ে এক খন্ড মাটিতে সুনিপুণ হাত বুলিয়ে তৈরী হতো নানা আকৃতির হাঁড়ি পাতিল। সারাদিন রোদে শুকিয়ে পুইনঘরে কাঠখড় দিয়ে পুরে তৈরী হতো টনটনে হাঁড়িপাতিল ও নানা রকম বাসন কোসন। হাটে বাজারে গ্রামে গঞ্জে সেসব বিক্রি করে তাদের ঘরে আসতো সংসার খরচের নগদ অর্থ।

২৮ ডিসেম্বর সোমবার সরজমিন মল্লিকবাড়ী পালপাড়ায় গেলে প্রদীপ পালের স্ত্রী অর্চনা পাল (৩৫) জানান“ ১৬ বছর বয়সে শাঁখা সিঁদুর পরে স্বামী শশুরের ভিটায় এসে কাঠের চাকা হাতে লয়ে সংসারের হাল ধরেছিলাম,খেলনা পুতুল,হাতি, ঘোড়া, ভাতের পেয়ালা, ভাতের ডহি, পানির হাঁিড় কলস, পিঠার খোলা, খৈ ভাজার পাতিল, গরুর চাড়ি, ধান চাল রাহনের বড় ঝালা, মুটকি, আলো জ্বালানোর মাটির প্রদীপ কতকি বানাইছি, এত কাজ ছিল যে ভাত খাওয়ার সময় অইতোনা, ফইরারা ঘাটে নাও বাইন্দা বাড়ীততন পাতিল নিয়া যাইত নাও ভইরা ।“অহন আর অত কাজ নাই, মিষ্টির দোকানে দৈএর পেয়ালা আর রসের হাঁড়ি, পিঠার খোলা পাইলা ছারা আর কিছুই চলেনা, পেটের দায়ে সাত পুরুষের কাম কইরা কোন রকমে বাইচ্চা রইছি”। তাদের তৈরী প্রতিটি দৈয়ের পাতিল আড়াই টাকায় বিক্রি হয় ফরিয়াদের কাছে। ফরিয়ারা নিয়ে পাঁচ টাকা করে বিক্রি করে মিষ্টির দোকানে। মাটি প্রস্তুত থাকলে সারাদিনে ১০০ পাতিল তৈরী করতে পারেন। তাদের দুই শিশু সন্তান রয়েছে সাগর পাল (৮) তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে আর মেয়ে ২ বছর বয়স। সামান্য আয় রোজগারে অতি কষ্টে সংসার চলে। তার উপর এনজিও হতে নেয়া ঋণের টাকার কিস্তি পরিষোধে হিমসিম খেতে হয় সারা মাস। টুরকিতে পাতিল ভরে মাথায় নিয়ে ময়াল করতে যাচ্ছিল স্বামী পরিত্যাক্তা সন্ধ্যারানী পাল (৫৫)। নিজের তৈরী নয় পার্শ্ববর্তী কালিয়কৈর হতে মাটির বাসন পত্র কিনে এনে মল্লিকবাড়ী বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। দিনে দুই থেকে আড়াইশ টাকা মুনাফা পান। অনেকদিন পূর্বে স্বামী পরেশ পাল দ্বিতীয় বিয়ে করায় নিঃসন্তানী সন্ধ্যারানী স্বামীকে ত্যাগ করে চলে আসেন। সন্ধ্যারানী দ্বিতীয় বিয়ে করেননি কিন্তু হাতের শাখা মাথার সিঁধুর আজও শোভা পাচ্ছে। বহু বছর যাবৎ মল্লিকবাড়ী বাজারে এক নিকট আত্মীয়ের আশ্রয়ে থেকে নিজে ব্যাবসা করে জিবিকা চালাচ্ছেন।

তিনি জানান চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ আসলে তাদের তৈরী খেলনা সামগ্রী, মাটির বিভিন্ন সাইজের পাতিলের ব্যাপক কাটতি হতো। মাটির পাতিলে করে গ্রামের মেলা থেকে মুড়ি ও গরম গরম জিলিপি কিনে দলবেঁধে বাড়ী ফিরা ছিলো নব বর্ষের উৎসবের চির চেনা বৈশিষ্ট। এখন আর সেই রকম আয়োজন হয়না। মাটির পাতিলের কদর আগের মত না থাকায় তাদের আয় রোজগার একেবারেই কমে গেছে।
পরাণ পাল জানান তাদের তৈরী জিনিষ পত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় আয় রোজগার নাই বললেই চলে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে অতি কষ্টে তাদের জীবন চলে। এক সময় তাদের তৈরী মাটির আসভাব পত্র বিক্রি করে সারা বছরের সংসার খরচ চালিয়ে দু’পয়সা উপড়ি থেকেছে। আবাদী জমি নাই যে ফসল ফলিয়ে তা দিয়ে ছেলে মেয়ের ভরন পোষন চালাবেন। অর্থকড়ি নেই যে পেশা বদলিয়ে অন্য ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করবেন। সরকারী সাহায্য সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। গৃহস্তের কাছ থেকে চড়া দামে এঁটেল মাটি কিনে কিছু কিছু হাঁড়ি পাতিল তৈরী করেন। পাতিল পুড়ার পুঁইন জ্বালানোর লাকড়ির দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় বাজারে মাটির হাঁড়ি পাতিলের দাম পাওয়া যায়না।

এই এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের ৩০/৪০ টি পরিবার এখনও বাপ দাদার ভিটেবাড়ি আকড়ে ধরে পরে আছে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবিকার তারনায় কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে পেশা বদল করেছে। আবাহমান বাংলার গৃহস্থ পরিবারের নিত্য কর্মের সহায়ক চিরচেনা প্রাচীনতম ঐতিয্যভরা মৃৎশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে তারা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছে।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

ভালুকা বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই