তারিখ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

বিরাট নগরকে প্রত্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণার দাবি

বিরাট নগরকে প্রত্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণার দাবি
[ভালুকা ডট কম : ২৪ অক্টোবর]
সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জে মহাভারত খ্যাত বিরাট রাজার বিরাট নগরের মহামূল্যবান প্রত্ন-সম্পদ চুরি হয়ে যাচ্ছে। প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন ঐ শহরের ধ্বংসস্তুপের সহস্রাধিক ঢিবির মধ্যে অধিকাংশ ঢিবির স্মৃতিচিহ্ন ও প্রত্ন-সম্পদ ইতোমধ্যেই নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে। দৃর্বৃত্তরা বেপরোয়া খোঁড়াখুঁড়ি করে চুরি করে নিয়ে গেছে ইট মাটি ও প্রাচীন স্থাপনার নানা সরঞ্জাম। সিংহভাগ জায়গা-জমি বেদখলও হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় প্রত্নতাত্মিক গবেষণা ও উৎখননের অভাবে এর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু আর অবশিষ্ট থাকছে না। ফলে কোথায় কোথায় সেই ঢিবিগুলো ছিল তা সনাক্ত করাও এখন দুরূহ। এলাকার বিশিষ্টব্যক্তিগণের ধারণা- প্রতিটি ঢিবির অন্তরালেই ছিল অতি প্রাচীন মূল্যবান প্রত্নতাত্মিক নির্দশন।

পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ইতিহাস হতে প্রাপ্ত সূত্রমতে -বিরাট রাজার রাজধানী শহর ছিল তৎকালীন প্রমত্তা করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে (এখন মরা করতোয়া) বর্তমান ধামাইনগর ও সোনাখাড়া ইউনিয়নের প্রায় ১২ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে। বিরাট নগরের কিঞ্চিৎ ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখন ক্ষিরিতলা বুরুজ ও অর্জুণগড়সহ মাত্র কয়েকটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ শুধু দৃশ্যমান।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ১নং ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষীরিতলা মৌজায় এই ক্ষীরিতলা বুরুজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বুরুজটি অবস্থিত। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো বেদখলমুক্ত প্রায় ৩০ বিঘা ভূমি (খাস) এখানে বিদ্যমান। সমতল ভূমির চেয়ে স্থানটি সুউচ্চ। একারণে এলাকাবাসী এই স্থানকে বুরুজ (উঁচুস্থান বা দুর্গ) বলে থাকে। ক্ষিরতলা বুরুজের শীর্ষ স্থানে জন্ম নেয়া কালের স্বাক্ষী বিশাল পাকুড় গাছের শিকড়ের ফাঁকে ফাঁকে এখনো দেখা যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের কার্ণিশ। এলাকাটি অরক্ষিত থাকায় কতিপয় দুর্বৃত্ত গুপ্ত ধনের আশায় খোঁড়াখুঁড়ি করে এর বিপুল পরিমাণ ইট চুরি করে নিয়ে গেছে। জনশ্রুতি আছে স্বর্ণ-রৌপ্যসহ এখানে অনেকেই পেয়েছে অনেক কিছু। উপজেলার ঝাপড়া গ্রামের অধিবাসী জনৈক শীতল সাহা ধনরত্ন পাওয়ার আশায় বুরুজের একাংশে খনন করেছিলেন। সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভুতপুর্ব মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ নোলন সাহেবের আমলে ও জমিদার বনওয়ারী লালের সময়েও এই ক্ষিরিতলা বুরুজের স্থান একাধিকবার খনিত হয়েছিল (পাবনা জেলার ইতিহাস)। এসব অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে পোড়ো প্রাসাদটির প্রকৃত অবস্থার চরম ক্ষতি হয়েছে।

মহাভারত গ্রন্থ ও ঐতিহাসিকগণের মতে -কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শক্তি সংগ্রহের নিমিত্ত পঞ্চপান্ডব ঐস্থানে বিরাট রাজার আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন। ফকির বিদ্রোহের শীর্ষ নেতা ফকির মজনু শাহও শক্তি সংগ্রহ ও তার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চৌকস করে (১৭৭০-১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য সুরক্ষিত আস্তানা গড়ে তোলেন বিরাট রাজার পোড়ো রাজমহল ক্ষিরিতলা বুরুজ এলাকায়। তখন দ্বীপের ন্যায় এলাকাটি গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। পুর্ণিয়ার প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগীয় কাউন্সিলের ১৭৮০ খিৃষ্টাব্দের ১৪ মার্চের রিপোর্ট থেকে এতথ্য জানাগেছে। ক্ষিরিতলা জঙ্গল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ৪ বছরের অধিককাল যুদ্ধ পরিচালনা করেন ফকির মজনু শাহ্। তার বাহিনীর জোয়ানরা ১৭৭১ সালে বৃটিশের আজ্ঞাবহ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মহারাজের পুর্ব পুরুষ শ্রী চন্দ্র শেখর আচার্যকে ময়মনসিংহ থেকে বন্দী করে এনে ক্ষিরিতলায় কিছুদিন আটক করে রাখেন। পরে ১৭৭৬ খিৃষ্টাব্দে ফকির মজনু শাহ বগুড়া জেলার মহাস্থানে আরো একটি দুর্গ গড়ে তোলেন। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন বগুড়া জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ফ্রান্সিস গডউইন কর্তৃক দিনাজপুর রাজস্ব কাউন্সিলে প্রেরিত রিপোর্টে শাহ মস্তান ফকির দলের অত্যাচার (ইংরেজদের ভাষায়) ও ঐ দুর্গের কথা উল্লেখ আছে।

অন্যদিকে রায়গঞ্জ উপজেলার ২নং সোনাখাড়া ইউনিয়নে অর্জুণগড় অবস্থিত। টিলার মত একটি সুউচ্চস্থান। এখানে বর্তমানে একটি দুর্গা মন্দির ও একটি আশ্রম রয়েছে। ক্ষিরিতলা বুরুজের প্রায় ১ কিঃমিঃ দক্ষিণ দিকে নিমগাছি ধামাইনগর সড়কের লাগোয়া পশ্চিম পার্শ্বে এই অর্জুণগড়। মহাভারত গ্রন্থ মতে, পঞ্চ পান্ডবের দ্বিতীয় পান্ডব অর্জুণ বৃহ্ননলার ছদ্মবেশে ঐস্থানে অবস্থিত বিরাট রাজার নৃত্যশালায় নৃত্য-গীতের শিক্ষক হিসাবে এক বছরকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নামানুসারে ঐস্থানের নাম হয় অর্জুণগড়।

খৃষ্টপুর্ব ৫শ’ অব্দের আগে থেকে এই এলাকা বিরাট রাজার রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা (এ্যাড. ফজলুর রহমান খাঁ কৃত সিরাজগঞ্জের ইতিহাস)। রাজ্যের নাম ছিল ‘মৎস্যদেশ’। বিশাল জল রাশির মাঝে দ্বীপের ন্যায় ছিল এই মৎস্যদেশের রাজধানী বিরাট শহর। ঐ শহরের তিন হাজার বছরের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। গৌতম বুদ্ধ জন্ম গ্রহন করেন খৃষ্টপুর্ব ৫৬৭ অব্দে এবং দেহত্যাগ করেন খৃষ্টপুর্ব ৪৮৭ অব্দে ৮০ বছর বয়সে। বুদ্ধদেব যখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করছিলেন তখন হস্তিনাপুরে পান্ডবদের রাজত্ব চলছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রমতে জানাযায়। বৌদ্ধ ধর্মের পুর্বে আর্য ও বৈদিক (সনাতন) ধর্মের প্রচলন ছিল। গৌতমবুদ্ধ ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারকালের কিছুকাল আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। আর এরও আগে পঞ্চপান্ডব ছিলেন বিরাট রাজার আশ্রয়ে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে ইহা প্রায় তিন হাজার বছর আগের ঘটনা। অতএব বিরাটনগরের বয়স তিন হাজার বছরের বেশি এতে কোন সন্দেহ নাই।

রায়গঞ্জের নিমগাছিতে বিরাট রাজার কাছারি ও দক্ষিণ গো-গৃহ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। নিমগাছির চারিদিকে ছিল বিশাল জলরাশি পরিবেষ্টিত। প্রায় আড়াই শ’ বছর আগেও নিমগাছি থেকে পাবনা জেলার দ্বোগাছি পর্যন্ত খেয়া নৌকায় পরাপার চলতো। নিমগাছির প্রায় ৪ কিঃ মিঃ উত্তরে ক্ষিরতলা বুরুজ অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের মতে (সিরাজগঞ্জের ইতিহাস) এটাই ছিল মৎস্যদেশ অধিপতি বিরাট রাজার রাজমহল। = বিরাট শহরের রাজবাড়ির সম্মুখভাগে একটি ক্ষিরিগাছ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। একারণে স্থানটি ক্ষিরিতলা নামে পরিচিত। এলাকার প্রত্নতত্ব প্রেমী ও ইতিহাস অনুরক্ত বিশিষ্টব্যক্তিগণের দাবি জরুরী ভিত্তিতে এলাকাটি প্রত্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করাসহ বিলুপ্তপ্রায় অবশিষ্ট স্থাপনার প্রয়োজনীয় উৎখনন ব্যবন্থা করা। এতে অতি প্রাচীন ইতিহাস ও তৎকালীন সভ্যতা উম্মোচিত হবে।

সম্প্রতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রিফাত-উর-রহমানের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের একটি দল নিমগাছিসহ ক্ষিরিতলা এলাকা পরিদর্শন করেন এবং বেশকিছু প্রত্নতাত্বিক নমুনা সংগ্রহ করেন। সুইডেনের লুনড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা প্রত্নতাত্ত্বিক মোঃ রিফাত-উর-রহমান ইত্তেফাককে বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অতীত সময়কে বোঝার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সূত্রের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন প্রত্নবস্তুর উপরে। আমরা গত চার মাস এই এলাকা জরিপ করে ইট, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এবং প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া এই প্রত্নস্থলের সময়কাল স¤পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবোনা। তবে প্রাপ্ত নমুনা থেকে আপাতদৃষ্টিতে ধারণা করা যায় যে প্রাচীনকালে এখানে একটি অতি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। এই মুহুর্তে প্রত্নস্থলটি উৎখননের জন্য বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। উৎখননের অনুমতি পেলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রত্নস্থল নিয়ে গবেষণা করতে প্রস্তুত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এটি একটি অসংরক্ষিত প্রত্নস্থল। যতো দ্রুত সম্ভব প্রত্নস্থলটিকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী। অনুমতি সাপেক্ষে এখানে উৎখননের ব্যবস্থা করা গেলে সুদুর অতীতের অনেক বিষয় উন্মোচিত হবে। জানাযাবে ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক অজানা অধ্যায়।

এব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন- এবিষয়ে লিখিত আবেদন করলে তিনি তা যাচাইয়ের জন্য প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরে পাঠাবেন।বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন- সিরাজগঞ্জের ক্ষিরিতলা বুরুজ সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। সরেজমিন পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ্ াগ্রহন করবেন বলে তিনি জানান।  #



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই