তারিখ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদ এমটিএফই

ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদ এমটিএফই অ্যাপে সর্বশান্ত নওগাঁর হাজার হাজার মানুষ,পাচার হয়েছে শতাধিক কোটি টাকা
[ভালুকা ডট কম : ২১ আগষ্ট] 
ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে অনলাইনে বিনিয়োগ করে কম সময়ে অধিক মুনাফার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার অন্যতম প্লাটফর্মের মধ্যে রিপটন কয়েন, সিজি ট্রেড ও এমটিএফই হচ্ছে অন্যতম অ্যাপ। বাংলাদেশে এগুলোর কোনটিরই বৈধ কোন নিজস্ব অফিস নেই। আছে শুধু এলাকা ভিত্তিক প্রতিনিধিগন। যে প্রতিনিধিরা কোম্পানীর কাছ থেকে পাওয়া বড় ধরণের একটি নির্দিষ্ট মুনাফার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের কম সময়ে অধিক মুনাফার আকর্ষনীয় লোভ দেখিয়ে কোম্পানীগুলোতে নিজস্ব এ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে অর্থ বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। 

তারই ধারাবাহিকতায় নওগাঁয় অনলাইন ভিত্তিক “এমটিএফই” নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে হাজার থেকে লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফার আয় করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। শহর কিংবা গ্রাম সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই অ্যাপটি। যেখানে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফার আয় করার স্বপ্ন দেখছিলেন। সম্প্রতি এই অভিনব পদ্ধতির ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ হারানোর কাহিনীটি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নি:স্ব হওয়ার পর কে কত অর্থ কিভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন তার সবকিছুই বেরিয়ে আসছে। অর্থবিনিয়োগের উপযুক্ত কোন কাগজপত্রাদি না থাকায় বর্তমানে অ্যাপে বিনিয়োগকারী সবারই মাথায় হাত।    

হঠাৎ করে এমটিএফই অ্যাপ থেকে বিনিয়োগকারীর নিজস্ব এ্যাকাউন্ট থেকে ডলারে পরিণত করা টাকা উধাও হয়ে গেছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারী প্রতিটি এ্যাকাউন্ট থেকে ওই অ্যাপটি আরো অর্থ পাবে মর্মে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়ে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থের আগে মাইনাস চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখছেন। এতে করে বিনিয়োগকারীরা পথে বসলেও কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এলাকা ভিত্তিক ওই কোম্পানীর সিইও নামক কতিপয় ব্যক্তিরা যাদের দেখানো প্রলোভনে ভুলে সকল শ্রেণির মানুষ অধিক লাভের স্বপ্ন বুনে এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন।  

জানা গেছে, বিদেশী অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) নামের একটি অনলাইন ট্রেডিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এমটিএফই অ্যাপটি চালু থাকা অবস্থায় একাউন্ট চালু করার জন্য সর্বনিম্ন ২৬ডলারের সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। সেই টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন পাওয়া যাবে শতকরা হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা। যার এ্যাকাউন্টে যত বেশি অর্থ থাকবে সে তত বেশি মুনাফা পাবেন। এমস সব লোভনীয় সময়পযোগী প্রলোভন দেখিয়ে প্রচারণা করছিল কিছু যুবক। আর এতেই হুমড়ি খেয়ে অ্যাপটিতে এ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। কোন কাজ ছাড়াই এই রকম মুনাফা পাওয়ার আশায় সেই এ্যাকাউন্টে কেউ জমি বন্ধক রেখে, কেউবা জমানো টাকা আবার কেউবা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা এমটিএফই অ্যাপের কয়েজন সিইও নামক ব্যক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন। নিযুক্ত সিইওরা কাউকে এ্যাকাউন্ট খুলে দিলে কোম্পানি থেকে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দেওয়ার পাশাপাশি তার মাধ্যমে যতগুলো ব্যক্তি বিনিয়োগ করবেন তাদের সবার কাছ থেকে ওই সিইও একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা পেতেন। 

ভুক্তভোগীরা জানান, এই আ্যাপে এ্যাকাউন্ট খোলার পর বিনোযোগ করা টাকার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হতো। হঠাৎ করেই এ্যাকাউন্ট থেকে তারা টাকা উঠাতে গিয়ে দেখে তাদের এ্যাকাউন্টে কোন ডলার নেই বরং তাদের এ্যাকাউন্ট থেকে কোম্পানী আরো পাবেন মর্মে মাইনাস চিহ্ন দেয়া হয়েছে। প্রতারণা করে তাদের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে এমটিএফই। লাভের আশায় এসে উল্টো ঋনের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই। এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছে। তবে প্রথম দিকে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন এবং যারা চতুর লোক তাদের অনেকেই মুনাফা তুলে নিয়েছেন। আর যারা বেশি মুনাফার আশায় এবং শেষের দিকে যারা ছিলেন যারা প্রাপ্ত মুনাফার অর্থ তুলে নিতে পারেননি তারা সর্বশান্ত হয়েছেন।

রাণীনগর উপজেলার বাজার এলাকার নিশাদ ইসলাম আকাশ বলেন তিনি মূলত অনলাইনে কাজ করেন। এই বিষয়টি জানার পর তিনি সম্প্রতি ৬০হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন এমটিএফইতে। তার দেখাদেখি তার আরো চারজন সহকর্মীরাও একই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন। অন্য সবার মতো তাদের অর্থও হাতিয়ে নিয়েছে ওই কোম্পানী। 

নাম প্রকাশ না করা শর্তে নওগাঁ শহরের এক ভুক্তভোগী জানান, একটু লাভের আশায় ধার করে ১লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছিলাম। কিছুদিন তারা ওই টাকার উপর লাভও দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে কিছুদিন আগে থেকে অ্যাপটি থেকে টাকা উঠানো বন্ধ করে দেন। এখন শুনছি তারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখন ধারের টাকা পরিশোধ করবো কিভাবে সেই চিন্তায় আছি।

তিনি আরও বলেন, লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই। সব ডলার কেটে নিয়ে উল্টো একাউন্টে বিশাল অংকের মাইনাস ডলার ধরিয়ে দিয়েছে। ২৪ঘন্টার মধ্যে তা পরিশোধ করতে বলেছে। ২৪ঘন্টা পর আজকে আবার তাদের অ্যাপে নোটিশ দিচ্ছে যে, ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে আপনি ঋণ পরিশোধ করেননি। আপনাকে আরো ২৪ঘন্টা সময় দেয়া হল, এরমধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে আপনাকে আইনী নোটিশ পাঠানো হবে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নিবেন তারা।

নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের ভুক্তভোগী আলামিন বলেন, একজন এসে বললো এমটিএফই টাকা ইনভেস্ট করলে নাকি দ্বিগুন পরিমাণ টাকা আয় করা যাবে। পরে একটি এনজিও থেকে ৬০হাজার টাকা তুলে সেখানে বিনিয়োগ করি। এখন ওই অ্যাপসে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে। এখন টাকাগুলো না পেলে এনজিওর টাকা পরিশোধ করবো কিভাবে ? কোন কিছু বুঝতে পারছি না।

রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আরেক ভুক্তভোগী নাঈম বলে, আমি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। একজনের পাল্লায় পরে লাভের আশায় কিছুদিন আগেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ২৫হাজার টাকা ইনভেস্ট করেছিলাম। কিন্তু তারা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল। এখন কিভাবে কি করবো কোন কিছুই বুঝতে পারছি না।

জেলার মহাদেবপুর উপজেলাতে লতিফুল লিটন নামে এমটিএফই অ্যাপের সিইও হিসেবে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তির খবর পাওয়া গেল তার সাথে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এসময় তিনি জানান, এমটিএফই অ্যাপের কোন সিইও তিনি ছিলেন না। তবে তিনি তার কয়েকজন বন্ধুদের সাথে নিজের মত করে এমটিএফই অ্যাপে কাজ করতেন।
 
এমটিএফই অ্যাপসের সিইও হিসেবে পরিচয়দানকারী রাণীনগর উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে রাব্বী জানান, প্রথমে মহাদেবপুর উপজেলার লতিফুল নামে একজন তাকে লিংক দিয়ে সেখানে কাজ করার জন্য বলেন। পরে তিনি সেখানে বিনোয়োগ করেন এবং বেশ কয়েকজনকেও উদ্বুদ্ধ করেন। তবে কাউকে কোন ধরণের প্রলোভন দেখানো হয়নি বলে দাবি করেন রাব্বী।

রাণীনগর উপজেলার আরেক অ্যাপ ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসার ডিলার রানা ট্রের্ডাসের মালিক রানা বলেন তিনি এমটিএফই নয় অন্য অনলাইন অ্যাপস ভিত্তিক কিছু আর্ন্তজাতিক মানের কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি উপযুক্ত কাগজপত্রাদির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ বিনিয়োগ করাচ্ছেন। যদি ভবিষ্যতে তার কোম্পানীগুলো উধাও হয়ে যায় তাহলে তিনি তার বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিজেই ফেরত দিবেন। 

রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন ভুক্তভোগীরা লিখিত ভাবে বিষয়টি জানালে তদন্ত সাপেক্ষে এই কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান বলেন, এবিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কেউ কোন অভিযাগ করেনি। কোন ভুক্তভোগী অভিয়োগ করলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।#






সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই